খেজুরের রস। গাছিরা সকাল হলেই ঠিলে বা ভাঁড়ে করে সেই রস নিয়ে চলে বাড়ির দিকে। শীতের সকালে গ্রাম বাংলার এ এক পরিচিত দৃশ্য। গাছিরা আগের দিন বিকেলে দিনের আলো থাকতে থাকতে খেজুর গাছের উপরিভাগে ভাঁড় বেঁধে রেখে আসে নলির মধ্যে। সেই নলি বেয়ে ফোটা ফোটা রস ভাড়ের মধ্যে পড়ে ভাড় ভরে যায়। পরের দিন সকালে গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য মাটির হাঁড়ি ব্যবহার করা হয়। এই হাঁড়িকেই বলে ভাঁড়। ঠিলে হিসেবেও হাঁড়ির নাম ব্যবহার হয়। যে যাই বলুক না কেন, ভাঁড়টি আসলেই খুব ছোট আকৃতির কলসের মতো হয়ে থাকে। মাঝারি আকৃতির দশ বা পনেরো ভাঁড় রস জ্বাল দিয়েই এক ভাঁড় গুড় হয়। সেই এক ভাঁড় গুড়ের ওজন ছয় থেকে আট কেজির মতো বলা চলে। গুড় তৈরির জন্য রস জ্বাল দেওয়া হয় মাটির জালায় বা টিনের তাপালে। খুব সকালে রস নামিয়ে এনেই জ্বালানো হয়। জ্বাল দিতে দিতে এক সময় রস ঘন হয়ে গুড় হয়ে যায়। গাছিরা যে যার বাড়ি এসেই ভাঁড় ভরা এই রস থেকে তৈরি করে গুড়। গ্রামে গ্রামে খেজুরের রস দিয়ে তৈরি করা হয় নলের গুড়, ঝোলা গুড়, দানা গুড় ও পাটালী। গুড়ের মিষ্টি গন্ধেই যেন অর্ধভোজন হয়ে যায়। চাষির বউ-ঝিয়েরা খেজুরের রস বা গুড় তৈরিতে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকে। এমন এক চমৎকার দৃশ্য বড়ই শৈল্পিক উপাখ্যান। শুধুই কি তাই, শীতের এই সকালে রস বা পাটালী গুড় তৈরিতে চুলার পাশে বসে অথবা লেপমুড়ি দিয়ে চিড়া, মুড়ির মোয়া খাওয়ার মজাই আলাদা। ইদানিং গুড়ের যেমন চাহিদা বেড়েছে, পাশাপাশি সমানভাবে রসের চাহিদা বেড়ে চলেছে। গাছ থেকে সদ্য পাড়া রস সকালে খেতে বেশ পছন্দ করে। রস বিক্রি করে এখন বহু মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। কারণ খেজুরের রস তাদের উপার্জনের পথ সুগম করে দিয়েছে।
আশ্বিন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহ (অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি) পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা হয়। ঠান্ডা আবহাওয়া, মেঘলা আকাশ ও কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল পর্যাপ্ত রসের জন্য উপযোগী। এই সময়ে প্রাপ্ত রসের স্বাদও ভালো হয়। পৌষ-মাঘ মাসে (ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি) তাই সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়। তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে রসের পরিমাণ ও মান কমতে থাকে। নূন্যতম ৫ বছর বয়সী গাছ থেকে রস সংগ্রহ শুরু করা হয়। গাছের বয়স, এলাকা বা মাটির প্রকারভেদ ছাড়াও একই মৌসুমের বিভিন্ন সময় ও গাছের যতেœর ওপর রসের প্রাচুর্যতা নির্ভর করে। আবার পুরুষ গাছ স্ত্রী গাছের চেয়ে বেশি রস দেয় এবং রসও তুলনায় বেশি মিষ্টি হয়।
খেজুর গাছ কাটার জন্য গাছের মাথার এক দিকের শাখা কেটে চেঁছে পরিষ্কার করে সেই কাটা অংশেরই নিচ বরাবর দুটি খাঁজ কাটার প্রয়োজন পড়ে। সে খাঁজ থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচে একটি সরু পথ বের করা হয়। এই সরু পথের নিচে বাঁশের তৈরি নলী বসানো হয়। এই নলী বেয়ে ভাঁড়ে রস পড়ে। নলীর পাশে বাঁশের তৈরি খিল বসানো হয়। সে খিলেই মাটির হাড়ি টাঙিয়ে রাখা হয়। বিকেল থেকে হাড়িতে রস জমা হতে হতেই সারা রাত্রিতে হাড়ে পূর্ণ হয়। গাছ কাটার পর দুই তিন দিন রস পাওয়া যায়। প্রথম দিনের রসকে বলে জিরান কাট। জিরান কাট রস খুবই সুস্বাদু। প্রথম দিনের রস থেকে ভালো পাটালি গুড় তৈরি হয়। দ্বিতীয় দিনের রসকে বলে দোকাট। তৃতীয় দিনের রসকে বলে তেকাট। রসের জন্য খেজুর গাছে একবার কাটার পর আবারও পাঁচ ছয় দিন পর কাটতে হয়। গাছের কাটা অংশ শুকানোর জন্য এসময় দেয়া প্রয়োজন পড়ে। খেজুর গাছ কাটা অংশ শুকানোর সুবিধার জন্যই সাধারণত পূর্ব ও পশ্চিম দিকে গাছ কাটা হয়। যাতে সূর্যের আলো সরাসরি কাটা অংশে পড়ে।
শীত আসে। সেই সঙ্গে হাজির হয় পিঠা উৎসব। এ সময় টাটকা চালে তৈরি করা হয় বাহারি পিঠা পুলি। পিঠার সেই মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে মূলত ঋতুর প্রথম ভাগ থেকে। এ গেল দেশ-গ্রামের কথা। শহরে কিংবা প্রবাসেও নরনারীরাও এই আয়োজন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চান না। তারা ছেলেমেয়ে বা প্রিয়জনদের সামনে আনেন মুখরোচক সব পিঠা। এ যেন শীতের সকালের নাস্তা। গ্রাম বাংলার সাথে মিশে আছে এই খেজুর রস। প্রত্যেক শীতকালে মেয়ের বাড়ি হাড়িতে রসের পিঠা পাঠানো এ যেন বাংলার এক সংস্কৃতির অংশ। খেজুর রস বাংলাদেশের সব এলাকায় কম বেশি হয়। তবে খেজুর রসের জন্য বিখ্যাত যশোর জেলা। এখানে এখনও এমন গাছি আছে যারা একশ খেঁজুর গাছ থেকে রস নামায়। আর এ রস থেকে তৈরি হয় গুড়, মোয়া, পাটালী যা খেতে খুব আকর্ষণীয়। এসব খাবার সবাই পছন্দ করে। তবে এখন গাছ ধ্বংসের যে পরিকল্পনায় মেতে আছে মানুষ। তাতে বেশিদিন থাকবে না গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য খেজুর গাছ ও রস।
আমন গোলায় ধান তোলার পর গ্রাম ভাসে আনন্দের বন্যায়। ধান কাটা ও গোলায় ভরার এ উৎসব নতুন এক খবর দেয় জনপদে। এ সময়ে প্রকৃতির দান খেজুরের রস। স্কুল ছুটি হয়ে যায়। মামা বাড়ি বেড়ায় ছোটরা। পিঠার ধুম পড়ে যায়। এটা শাশ্বত বাংলার ছবি। সে বার্তায় থাকে পিঠার আমন্ত্রণ। শীতের সকালে খেজুর রসের স্বাদই আলাদা। সে রসে ভেজানো চিতই পিঠার ঘ্রাণ টানে পাড়ার মানুষকে। প্রচলিত পিঠার মধ্যে পাটিসাপটা, পুলি বাদ পরে না। পাতা পিঠা, ঝাল পিঠা, নারকেল পিঠা, ভাঁপা পিঠা কত কি! কেউ আবার নকশা পিঠা, ঝিনুক পিঠা, জামদানি পিঠা তৈরি করেন। সূর্যমুখী, গোলাপি, দুধপুলি, রসপুলি, দুধরাজ পিঠাও অসাধারণ। আর খেজুর গুড়ের প্রচলিত সন্দেশ হয় তার স্বাদ অপূর্ব। সন্দেশ, আন্দশা, মালপোয়া, পাজোয়া-কী সুন্দর সুন্দর নাম!
ফলের দোকানের কাঁচের বয়েমে রাখা যে খেজুর আমারা কিনে থাকি এ খেজুর সে খেজুর নয়। এই খেজুর আরব দেশের খেজুর। এখানে যে খেজুর গাছ এবং খেজুরের রস নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে তা এখানকার আঁটিসার ছোট ছোট খেজুরের কথা। বাংলাদেশে বিশেষ করে খেজুরের সমাদর শুধুমাত্র রসের জন্য। রস থেকে তৈরি নলেন গুড় ছাড়া পৌষের পাঠালি, পিঠে, মোয়া, প্যাড়া বিশেষ করে জয়নগরের মোয়া সবারই কদর। আজ বাঙালির ঘরে ঘরে বাংলাদেশের খেজুরের চাষ তাই মূলত রস, গুড় আর পাঠালির জন্য। তবে খেজুরের পাতা মোটেই খেলনা নয়। খেজুরের পাতার ঝাঁটা ও চাটাই গরিব বাঙালি গৃহের ঘরে ঘরে সমাদৃত। গ্রামবাংলার অভাবী মেয়েরা রঙ বেরঙয়ের যেসব খেজুর পাতায় খেজুর পাটি তৈরি করে তার উপরই যেন চলে রস খাওয়ার আসর। উপার্জনের জন্যই খেজুর পাতা শুকিয়ে তা দিয়ে খেজুরপাটি তৈরি পর বিক্রি করে সংসারের কিছুটা অর্থ সংকোলান হয়। সুতরাং এই খেজুরের পাটিতেই গ্রামের এক সময় অনেক পরিবার ঘুমানো কাজে তা ব্যবহার করতা। খেজুর পাতায় এক ধরনের সাহেবী টুপিও তৈরি হয়। খেজুরের পাতা, ডাল এবং গাছ শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। আর মোরব্বা তৈরিতেও খেজুর কাটার ব্যবহার প্রচলিত আছে। (ছবি: গুগল খেকে সংগৃহীত)
এই সংবাদটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন